আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে বাংলাদেশে যখন ইসলামী ব্যাংকিং -এর কথা কেউ কল্পনাও করেনি তখন শায়খ মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব ১৯৮১ সালের ২৬ এপ্রিল রােজ রবিবার তাঁরই প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর উপর দু’দিন ব্যাপী খুবই ব্যয়বহুল আড়ম্বরপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা থেকে আগত বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এম. খালিদ খান। উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বহু সম্মানিত ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, ইসলামী চিন্তাবিদ, উলামায়ে কেরাম, সাংবাদিক শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তিবর্গ।
উল্লেখ্য যে, তথায় সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় যারা পড়াশুনা করেন তাদেরকেও আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। শায়খ মাওলানার অভিমত “তাদের বক্তব্য যদি আমি না শুনি আমার বক্তব্য তারা শুনবে কেন?”
উক্ত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর জনাব আতাউল হক। গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন সোনালী ব্যাংক স্টাফ ট্রেনিং কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল জনাব আজিজুল হক।
১৯৮০ সালের নবেম্বরে দেশে বেসরকারী খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া হয়। বাংলাদেশে বেসরকারী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে শরীয়া মোতাবেক একটি ব্যাংক চালুর এ উদ্যোগ ছিল ব্যতিক্রমি ও সাহসি। এর পেছনে তখন আর্থিক লাভের হাতছানি বা ডিভিডেন্ড পাওয়ার লোভ ছিল না। পুরো মূলধন হারানোর ঝুঁকি ছিল। এ অবস্থার মধ্যেই অল্প ক’জন লোক শরীয়া মোতাবেক ব্যাংক চালুর চ্যালেঞ্জ নিয়ে উজান স্রোতের যাত্রী হন।
ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য তখন আট কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন প্রয়োজন। তার মধ্যে পাঁচ ভাগ বা চল্লিশ লাখ টাকা দেবে সরকার। দশভাগ বা আশি লাখ টাকা আসবে পাবলিক শেয়ার থেকে। বাকি পঁচাশি ভাগ বা ছয় কোটি আশি লাখ টাকার মূলধন যোগতে হবে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে বায়তুশ শরফ ফাউন্ডেশন দশ লাখ টাকা এবং অন্যরা প্রত্যেকে পাঁচ লাখ টাকা করে মোট এক কোটি বিশ লাখ টাকা যোগাড় করেন। ইসলামী ব্যাংকিং আদৌ সম্ভব হবে কী-না তা নিয়ে তখন অধিকাংশ ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদের বিস্তর সন্দেহ ছিল। দেশের বড় ব্যবসায়ী বা শিল্প গোষ্ঠিরা উতসাহ দেখায়নি।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিরূপে নিবন্ধিত হয়। বিধিবদ্ধ বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকরূপে ইসলামী পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য ২৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স ইস্যু করে। ১৯৮৩ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে কাজ শুরু করতে হবে। এই বাধ্যবাধকতার কারণে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ রাজধানী ঢাকার ৭৫ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় চার তলা ভবনের তৃতীয় তলার উত্তরাংশের একটি কক্ষে পথ চলা শুরু করলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ছত্রিশতম এই ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক ।
এ ঘরোয়া অনুষ্ঠানে মৌখিক দাওয়াতে বায়তুশ শরফের পীর মওলানা আবদুল জব্বার, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী সভাপতি জনাব কফিলউদ্দীন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এম খালেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক এ এস এম ফখরুল আহসান, প্রবীণ সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী ও আখতারুল আলমসহ ঢাকার কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী দিনে দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলার বাণী, দৈনিক সংগ্রাম, বাংলাদেশ অবজারভার ও বাংলাদেশ টাইমস-এ চার পাতা ক্রোড়পত্র ছাপা হয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল এইচ এম এরশাদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নূরুল ইসলাম বাণী দেন।
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল এইচ এম এরশাদ বাণীতে বলেন: ‘আমি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি যে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ১২ই আগস্ট, ১৯৮৩ আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করছে। নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার পাশাপাশি এক চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে যথাযোগ্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার বেসরকারী খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে আসছেন। আশা করি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড জাতি গঠনমূলক কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে। জেদ্দাস্থ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকসহ বেশ কিছু সংখ্যক ইসলামী ব্যাংক ও সরকারী প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠাতা হবার প্রেক্ষিতে তাদের এই উদ্যোগ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভ্রাতৃসুলভ দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করবে। মুসলিম দেশসমূহের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক আমাদের দেশে বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের দিগন্ত আরও প্রসারিত করতে পারে। আমি এই ব্যাংকের উজ্জল ভবিষ্যৎ এবং এই মহতি উদ্যোগের সাফল্য কামনা করছি।’
উল্লেখ্য, ইসলামী ব্যাংক উদ্বোধনের ১২ আগস্ট তারিখ ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭৬৫ সালের এ তারিখের “ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজস্ব আদায় তথা আর্থিক প্রশাসনের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। এর মধ্যে দিয়ে ২১৯ বছর পূর্বে এদেশে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হয়। পরিণামে উক্ত তারিখ হতে এদেশের জনগণ স্বীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক লেনদেন পরিচালনার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয়। প্রায় সােয়া দু’শ বছর পর ১৯৮৩ সালের ১২ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের উদ্বোধনের মাধ্যমে এদেশের অর্থনৈতিক কারবার আবার সুদ মুক্ত পদ্ধতিতে জনগণের প্রত্যাশিত ধারায় ফিরিয়ে আনার শুভ সূচনা হয়।
Leave a Reply