সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহন না করেও যাঁর সোনালী ছোঁয়ায় অঢেল বিত্তবৈভব স্বদেশভূমির বৃহৎ স্বার্থে শিক্ষাসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে অবিনাশী হয়েছেন তিনিই বাংলার কৃতি সন্তান মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ:)। ১৯৩৩ সালে ১ ফেব্রুয়ারী মায়নমারের থাংগু জেলায় শায়খ মাওলানা জন্মগ্রহণ করেন।
১৯২৯ সালে কাজী নজরুল চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে এক ভাষন প্রদান করেন। ভাষনের এক পর্যায়ে নজরুল বলেছিলেনন- “শত শত, সাদী, হাফিজ, খৈয়ম, রুমী, জামী, শমশে-তবরেয এই সিরাজ বাগে (চট্টগ্রাম) জন্মগ্রহন করুক। সেই দাওয়াতের গুরুভার আপনারা গ্রহন করুন”। বোধ হয় সেই ঐশী নির্দেশেই অতি শৈশবে পিতামাতার সাথে মাওলানা লোহাগাড়া থানায় বড় হাতিয়ায় মিয়াজী পাড়া নিজ বাসভবনে মায়ানমার থেকে ফিরে আসেন।
১৯৪৮ সালে আলীম ১ম বর্ষে অধ্যয়নকালে পবিত্র শবে বরাতের রজনীতে স্বীয় হুজুরা খানায় তাঁর মুর্শিদ মাওলানা শাহ সুফি মীর মুহাম্মদ আখতর (রহ:) তাকে বায়াত করান। তাঁর মুর্শিদ প্রায় দু’বৎসর অসুস্থ ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় মাওলানাকে সার্বক্ষনিক তার চোহবতে রেখে তালিম দিতেন। খেলাফতের গুরুদায়িত্ব অর্পনের জন্য মাওলানাকে রুহানি ফয়েজ দ্বারা গড়ে তোলে ক্রমান্বয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে নিয়ে চললেন।
অবশেষে ১৯৩১ সালে হজ্বের সময় মক্কা শরীফ থেকে মদিনা শরীফ যাওয়ার পথে একটি ছোট দু’তলা ঘরে তাঁর মুর্শিদ মাওলানাকে ডেকে আনলেন। তরীকতের ভাইদের উপস্থিতিতে বললেন “আমি এতদিন মাওলানার পরিচয় মানুষের নিকট প্রকাশ করিনি। কারণ সময় হয়নি। লোকজন তাঁর আসল পরিচয় পেলে তাঁকে সময়ে অসময়ে বিরক্ত করা শুরু করত, তাতে আধ্যাত্বিক উন্নতি ব্যহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমি দোয়া করি সময়মত তাঁকে মানুষের নিকট পরিচয় করিয়ে দেবেন। তখন এমনভাবে মানুষ তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়বে যে, তার আহার-নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটবে”। মাওলানার বিশ্বাস তাঁর মুর্শিদ তাঁকে পূন্যভূমি মক্কার কাবাশরীফ ও মদিনার পবিত্র রওজা শরীফের মধ্যাখানে খেলাফতে কঠিন দায়িত্ব অর্পনের অর্থ আমানতদারী, সততা, প্রভৃতি মানবীয় গুনে গুনান্বিত হয়ে সৃষ্টির সেবা ততা ইসলামের মূলনীতি বুলন্দ করা।
এরপর শুরু হলো মাওলানার পথ চলা। কন্টকাকীর্ন কর্দম পথকে মাড়িয়ে নবনব সৃষ্টির উল্লাসে তিনি জোর কদমে সম্মূখ পানে এগিয়ে চললেন। সর্বপ্রথম অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আনজুমনে ইত্তেহাদের রূপরেখা প্রনয়ন করেন। উল্লেখ্য যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানী দিপ্ত বিশাল জনশক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কোন মহৎ কার্য্য সম্পাদনকে আনজুমনে ইত্তেহাদ বলা হয়। আবার এ আনজুমনে ইত্তেহাদের কর্মধারাকে বাস্তবায়ন করতে হলে তরুণ সম্প্রদায়ের দরকার। যেহেতু তরুণরাই পারে অসহায়, লাঞ্চিত, বঞ্চিত লক্ষ জনতার মুখে হাসি ফোটাতে। তাই হুজুর পাক (সা:) “হলফ-উল-ফযুল” নামে যে সেবা সংঘ গঠন করেছিলেন সেই আদলে বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের বিপদগামী তরুণ সমাজকে অবক্ষয় থেকে মুক্তি দিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ার অভিপ্রায়ে মাওলানা প্রতিষ্ঠা করেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সমাজসেবী যুবকাফেলা আনজুমনে নওজোয়ান বাংলাদেশ।
ফলশ্রুতিতে মসজিদ নববীর অনুরুপ বায়তুশ শরফকে কেন্দ্র করে মাওলানা বলিষ্ট নেতৃত্বে ইসলামের আলোকধারা বসরাই গোলাপের ন্যায় সমগ্র বাংলাদেশ তথা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারকল্পে তৎকালীন আরব বিশ্বে ফাতেমীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ ‘দারুল হিকমা’ স্থাপন করেন। ৮৩০ সালে খলিফা আল মামুন ‘জ্ঞানগৃহ’ নামীয় এক বিখ্যাত পাঠাগার স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের আদলে খ্রীষ্টান জগতে গড়ে উঠে আশ্রম। মাওলানা তাঁর দূরদর্শী চিন্তাভাবনা দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন যে, বিলাস ব্যাসনে ডুবে থাকা মুসলমানদের নিদ্রা ভঙ্গ একান্ত প্রয়োজন। তাই মৌলিক গবেষনা তথা বিভিন্ন প্রযুক্তি আবিস্কারের অভিপ্রায়ে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের জন্য ১৯৮০ সালে ২৮শে ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন “জ্ঞান গৃহ বা দারুল হিকমার” অনুরূপ “বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষনা প্রতিষ্ঠান”।
১৯৮১ সালে বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এক আলোচনা সভা ও জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের ফল স্বরূপ ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা”। উক্ত মাদরাসার ছাত্রগণ বর্তমানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশ গড়ার মহৎ কাজে নিয়োজিত।
অপসংস্কৃতির মরণ ছোবলে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা তথৈবচ। তাই ১৯৮৫ সালে ১৭ অক্টোবর ০৩ দিন ব্যাপী বায়তুশ শরফ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইতিহাসবীদ ড. আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও গবেষকদের সমন্বয়ে “বাংলাদেশ ইসলামী ঐতিহ্য” বা “বাংলাদেশ ইসলাম” শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনারের আহবান করা হয়। উক্ত সেমিনারে ১৭টি প্রবন্ধ পঠিত হয়। প্রতিটি প্রবন্ধ ছিল তথ্যবহুল।
দূরদর্শী চিন্তার দ্বারা মাওলানা বুঝতে পারে যে, যে দেশে গুণীদের কদর নেই, গুণীর সমাদর নেই, সেসব দেশ তথাকথিত মহাবিজ্ঞানীদের ঘাতক দেশে পরিণত হয়। গুনীজনকে সম্মান দেয়ার অর্থই হচ্ছে গুণী সৃষ্টির পথ সুগম করা যেহেতু গুণীজনের আধিক্য বা স্বল্পতার উপরই একটি দেশের উন্নতি বা অবনতি নির্ভর করে। সুতরাং নব প্রজম্মকে ইসলামী আদর্শ চর্চায় অনুপ্রানিত করার লক্ষ্যে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স:) উপলক্ষ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে সম্পূর্ণ নতুন অথচ এক বিস্ময়কর কর্মসূচী “গুণীজন সংবর্ধনার” সূচনা করেন বাংলার এই কৃতি সন্তান মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ:)।
এই গুণীজন সংবর্ধনায় প্রতি বৎসর দু’একজন শ্রেষ্ঠ কবিকে সম্মানিত করা হয় যেন সমস্ত কবি সমাজ দ্বীন ও স্বদেশের উদ্দেশ্যে আরও গঠনমূলক কবিতা প্রবন্ধ লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়। তেমনি দু’ একজন শ্রেষ্ট বিজ্ঞানী বা সমাজ সংস্কারককে সম্মানিত করা হয়। যেন তাঁরা স্বদেশের হিতার্থে নব নব আবিস্কার জাতির দুঃখ দুর্দশা উত্তরনে লাঘবে সহায়ক হয়। এই সংবর্ধিত গুণীজনের মধ্যে রয়েছেন প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, কবি আল মাহমুদ, হযরত মাওলানা মুহি উদ্দিন খান, ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর সহ আরও অনেকে। আসলে গুণীজন মানব জাতির এক অমূল্য সম্পদ। এই গুণীজনেরাই একমাত্র গবেষনার দ্বারা নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশ তথা জাতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। বাস্তবিকই গুণীজনকে সংবর্ধিত করার মাধ্যমে মাওলানা বাঙ্গালী জাতির এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের গোড়াপত্তর করেন। এই গুণীজন সংবর্ধনাকে মিনি ‘নোবেল পুরস্কার’ বললে ও অত্যুক্তি হবেনা।
মাওলানার বিজ্ঞান মানস বাংলাদেশের জন্য আর এক নবদিগন্তের সূচনা। তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং হাদিসগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রপ্ত করার চেষ্টা করেন। যেমন ‘জ্ঞানীদের কথা মন দিয়ে শুন এবং বিজ্ঞানের শিক্ষা অন্যদের নিকট সঞ্চারিত করা ধর্মাচার অনুষ্ঠানের চেয়ে উত্তম।’ অন্যত্র ‘সৃষ্টিকর্তার কীর্তিগুলো সম্বন্ধে এক প্রহর ধ্যান করা সত্তর বৎসর ইবাদতের চেয়ে উত্তম’ অথচ মাওলানা কোন বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না, কিংবা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতও ছিলেন না। শুধুমাত্র মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। দৃষ্টান্ত স্বরুপ বলা যায় কৃষি সম্পর্কে চিন্তা করতে গিয়ে তাঁর দৃষ্ট্ িআটকে যায় বাংলাদেশের ডোবা নালায় অবহেলিত কচুরিপানা। তার সতীর্থদের নিকট তিনি সে ব্যাপারে আলাপও করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী গবেষনাগারে কচুরিপানার নিয়ে গবেষনা না করলেও তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, নিশ্চয়ই মানুষের ব্যবহার উপযোগী কোন মূল্যবান জিনিস কচুরিপানা থেকে তৈরি হবে। পরবর্তীকালে গবেষনাকালে প্রতিয়মান হয় যে, এই কচুরিপানা মূল্যবান ‘বিউটিফুল ট্রয়েনট্রিজ’ তৈরির উপযোগী। সুতরাং এই কচুরীপানা নিয়ে গবেষণার পিছনে রয়েছে প্রচার বিমুখ মাওলানার অবদান।
তিনি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ থেকে শুর করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে সমস্ত বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন তার চতুর্দিকে বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে সুশোভিত করেন। যাতে গড়ে উঠে পক্ষকূলের আবাসস্থল। তাছাড়া পরিবেশ সংরক্ষনের অভিপ্রায়ে ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৩ সালে স্বীয় উদ্যোগে তার অনুসারীদের নিয়ে বৃক্ষরোপন কর্মসূচী পালন করেন। তদুপরি তার সংবর্ধিত গুনীজনের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ব বরেণ্যে বিজ্ঞানী ড. শমশের আলী, বিজ্ঞান মালিক আকবর আলী, প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
মাওলনার আর এক সৃষ্টি চিকিৎসা মানস। অসহায় গরীব রোগীদের আর্তনাদে মাওলানার হৃদয় সবচেয়ে বেশি উদ্বেলিত হয়েছিল । তিনি সর্বক্ষণই ভাবতেন কিভাবে গরীব রোগীদের উন্নততর চিকিৎসা সেবা প্রদান করা যায়। সেই উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছ হতে অনুদান না নিয়ে ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সে বায়তুশ শরফ দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেন। মাওলানা রাজধানীর বুকে ফার্মগেইটস্থ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সে ১৯৯০ সালে বায়তুশ শরফ দারুশ শেফা ক্লিনিক নামে একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য তিনি সূদর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস গমন করেন। পাকিস্তান আমলের পূর্ব হতে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময় পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিশেষ করে কক্সবাজার পাহাড়ী এলাকাসহ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন প্রভৃতি অঞ্চলে উন্নত চিকিৎসা সূদুর পরাহত ছিল। একেত ছিল দূর্গম দ্বিতীয়ত গরীব এলাকা। তাই মাওলানা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে উক্ত এলাকায় সাধারণ জনগণের চিকিৎসাক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।
১৯৯২ সারে ডিসেম্বর মাসে প্রথম কক্সবাজার শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে পর্যায়ক্রমে তাহা ফ্যাকো সার্জারি সম্বলিত অত্যাধুনিক চক্ষু হাসপাতালের উন্নিত হয়। অচিরেই এই হাসপাতালকে কেন্দ্র করে একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মহাপরিকল্পনা রয়েছে।
চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা মাওলানার আর এক অমর কীর্তি। ইতিহাস পর্যালোচনা করে তিনি বুঝতে পারলেন যে মুসলিম শাসনামলে বর্তমানের স্পেন উন্নতির মূলে ছিল শিক্ষা। তথা পবিত্র কুরআনের তফসীর, হাদিস, ফেকাহ ও অভিযান প্রনয়ন পদ্ধতি অধ্যয়ন। তখন কলেজগুলো প্রধান ফটকে খোদিত ছিল চারটি বাক্যের অনুসৃত নীতি পৃথিবীকে ধারণ করে আছে- জ্ঞানীর বিদ্যা, মহৎজনের সুবিচার, সত্যান্বেষীর প্রার্থনা আর সাহসীজনের শক্তি। তিনি এ সমস্ত গুনাবলী সৃষ্টির মানসে চট্টগ্রামে একটি পূর্নাঙ্গ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টায় সংকল্প গ্রহন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যেখানে সরকারও হিমশিম খেয়ে যায় সেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চাট্টিখানী কথা নয়। অনেক বিজ্ঞজন ও প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁকে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু স্বল্পভাষী কঠোর মনোবলের অধিকারী মাওলনা পিছু হটলেন না। সত্যিকার অর্থে ভয়, পিছু হাটা, দুদুল্যমান অন্তর এই বিশেষনগুলো মাওলানার অভিধানে ছিল না।
এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২ ইং সালে বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষনা প্রতিষ্ঠানে এক সেমিনারের আয়োজন করেন। ৫১ সদস্য বিশিষ্ট ‘চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করেন। অবশেষে ১৯৯৫ সালের আগষ্ট মাসে মাত্র ৩টি ফ্যাকাল্টির আওয়াতায় ৩টি বিভাগ নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে। এ উপলক্ষ্যে তিনি যে ঐতিহাসিক ভাষন প্রদান করেন তা জাতির জন্য এক অমুল্য সম্পদ হিসেবে চিরদিন অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
১৯৯৭ সালে ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম হোটেল আগ্রাবাদে মাওলানা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষ পুর্তি উপলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সম্মেলনে দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ছাড়াও বিশেষ করে ভারতের সাইয়েদ আহমদ শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর আল্লামা সালমান নদভী, পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আনিস আহমদ, মিশরের ওস্তাদ আল সাফাতী, কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. হামদ সালেহ আল রশীদ উপস্থিত ছিলেন। বাস্তবিকই শায়খ মাওলানা শুধুমাত্র চট্টগ্রাম, ঢাকা বা বাংলাদেশের গন্ডির মাওলানা নহে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের ব্যক্তিত্ব যিনি পশ্চিমা বিশ্বে জন্ম নিলে অবশ্যই নোবেল পুরস্কারের অধিকারী হতেন। আরও উল্লেখ্য যে, সে সময় কম্পিউটার দুর্লভ হওয়া সত্ত্বেও তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল হতে কম্পিউটার প্রদানের মাধ্যমে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাষ্টি উদ্বোধন করেন।
মাওলানা কর্তৃক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা আর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, আলেম সম্প্রদায় সুদ সম্পর্কে কুরআনের আলোকে অনেক ব্যাখ্যা প্রদান করেন কিন্তু সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথ কেউ উল্লেখ করেননি। কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার উপর তিনি এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন। মাহ্ফিল শেষে জনৈক বৃদ্ধ তাঁকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করেন “আপনি কি এ ধরণের ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে দেখাতে পারবেন? প্রত্যুত্তরে মাওলানা বললেন ‘ইনশাল্লাহ আমরা অবশ্যই সেই রকম সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার জনগণকে সুদের জিঞ্জির থেকে মুক্ত করব। ১৯৮১ সালে ২৬ এপ্রিল তারই প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম ইসলামী গবেষনা প্রতিষ্ঠানে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের উপর দুইদিন ব্যাপী খুবই ব্যয়বহুল আড়ম্ভরপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে দেশের র্শীর্ষ স্থানীয় সম্মানিত ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, ইসলামী চিন্তাবিদ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর এম. এ খালিদ খান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আতাউল হক, সোনালী ব্যাংকের স্টাফ ট্রেনিং কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জনাব আজিজুল হকসহ আরও অনেকে। সবার বক্তব্যের পর মাওলানা সমাপনী বক্তব্যে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তাবায়নের লক্ষ্যে কুরআনের আয়াত সম্বলিত চুলচের সহজ বিশ্লেষন প্রদান করেন। তাঁর বক্তব্য শুনে উপস্থিত জ্ঞানী-গুণী সবাই হতবাগ হয়ে যান। ইহাই শেখ-এ-তরীকতের আসল পরিচয়। এ সেমিনারকে ফলপ্রসু করার জন্য তিনি তৎকালীন সময়ে ১০,০০ টাকা ব্যয় করেছেন। অবশেষে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮৩ সালে ৩০ মার্চ পথ চলা শুরু করলো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক “ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড” যে ব্যাংক ইসলামী অর্থনীতির ‘ফিল্টার ম্যাকানিজম’ ‘দারিদ্র সংস্কৃতি’ ও ‘দারিদ্র দোযখ’ থেকে মুক্ত হবার রোড ম্যাপ।
আমৃত্যু তিনি এ ব্যাকের শরীয়াহ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, পরিচালনা পরিষদের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি বায়তুশ শরফ ফাউন্ডেশনের নামে ১০ লক্ষ টাকার প্রাথমিক তহবিল যোগান দেন।
প্রকাশিতব্য ভূইফোর পর্নছবি ম্যাগাজিনের মোকাবিলায় বাংলা ভাষায় কুরআন হাদীস চর্চা সহ সাহিত্যের কলম সৈনিক তৈরীর মানসে ২৮জুন ১৯৮০ সালে প্রকাশ করেন ইসলামী মননশীল পত্রিকা মাসিক দ্বীন দুনিয়া। প্রধান সম্পাদক শক্তিধর বিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক জনাব মাহমুদুল হক সাহেব, সম্পাদক অকুতোভয় কলমী বহু গ্রন্থ প্রনেতা জনাব জাফর উল্লাহ সাহেব।
মাওলনা মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ:) মায়ানমার থেকে বিতারিত ১৯৭৮, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ ইং সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে আর্থিক ও মানবিক সাহায্য প্রদান করেন । এরই ধারাবাহিকতার সুযোগ্য উত্তরসূরী বাহ্্রুল উলুম শাহসুফী আলহাজ্ব হযরত মাওলানা কুতুব উদ্দিন (ম.জি.আ.) তত্ত্বাবধানে এবং কক্সবাজার বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের মহাপরিচালক এম. এম. সিরাজুল ইসলামের দক্ষ নেতৃত্বে ২০১৭ ইং হতে অধ্যাবদি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে ত্রাণ, শিক্ষা ও চক্ষু চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রয়েছে। উত্তরবঙ্গ সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্যা দুর্গতের মধ্যে ১৯৮৭, ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে ত্রাণ বিতরণ করেন। তিনি ছিলেন অসম্প্রদায়িক। তাঁর সাহায্যের হাত থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান কেউ বঞ্চিত হয়নি। এখানে উল্লেখ থাকে যে কক্সবাজার বায়তুশ শরফ হাসপাতালের প্রথম চক্ষু অপারেশনকৃত রোগী ছিলেন একজন রাখাইন সম্প্রদায়ের।
তিনি ছিলেন একজন সফল সাহিত্যিক যিনি ২১টি পুস্তক রচনা করেন। তাঁর পবিত্র হাতে হাত রেখে ১০০ জন হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইসলামে ছাঁয়াতলে আশ্রয় নেন। বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক, চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১৫টি এতিমখানা, ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি একাডেমী, ১টি মাদ্রাসা, ৩টি হাসপাতাল ও ১টি ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ১ জানুয়ারী, ১৯৯২ সালে তাঁর কর্মময় জীবন নিয়ে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগ হতে এক মূল্যবান সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন বাংলা বিভাগের পরিচালক, প্রযোজক ও সংবাদ পাঠক কাফি খান, সরকার কবির উদ্দিন, সোহেল সামাদ, ইকবাল বাহার চৌধুরী ও মাসুমা খাতুন। ভিক্ষার হস্ত প্রচারিত না করে, অন্যর উপর নির্ভর না করে স্ব উদ্যেগে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বর্ণাঢ্য প্রতিষ্ঠানের উপর আলোকপাত করা হয়। একজন পীর সাহেব হয়ে মানবতাধর্মী উদ্যোগ “অনন্য” ও “ব্যতিক্রমধমী” বলে ভূয়সি প্রশংসা করা হয়। এক পর্যায়ে শায়ক মাওলানাকে “মিনি গভর্নম্যান্ট” হিসাবে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত: ইহাই মাওলনার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। যেহেতু এই বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তি যদি পশ্চিমা বিশ্বে জন্ম নিতেন তবে তাঁর ফোকাসে অবশ্যই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হতেন।
এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে আদ্যেপান্ত উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। আজ সমগ্র বাংলাদেশ চষেও এ ধরণের সর্বগুনে গুনান্বিত একজন ব্যক্তি পাওয়া খুবই দুস্কর।
তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক বা মরোনত্ত্বর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাওয়া উচিত। দেশের বৃহৎ স্বার্থে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রূপরেখা প্রনয়নের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা অবশ্যই কর্তব্য।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী বঙ্গের এই কৃতি সন্তান ২৫ মার্চ ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রিয় বন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যান। (ইন্নালিল্লাহ — রাজেউন)
জাকিয়া সুফিয়ান
লেখিকার পরিচিতি: জীবনীকার ও বিশিষ্ট প্রবন্ধ সাহিত্যিক
Leave a Reply